ধরুন আপনি বাড়ির কাজ শুরু করলেন। কিন্তু মাঝে এক বিপদে পড়ে আপনার জবটা চলে গেলো! কিংবা হতে পারে প্রবাসী আপনি সরাসরি দেশে ফিরে এলেন চাকরি ছেড়ে। এমতাবস্থায় বাড়ির কাজ শেষ করাটা আপনার বড্ড প্রয়োজন।
অথচ হাতে নেই টাকা! এমন কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই যারা কিনা আপনাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারে। এমন পরিস্থিতি আপনার দরকার লোন। আর এই লোন নেওয়ার সিস্টেমই হলো হোম লোন। অন্যান্য লোন সিস্টেমের মতো এই লোনের ক্ষেত্রেও আছে আলাদা কাইটেরিয়া।
চলুন জানি হোম লোন কি, হোম লোন কিভাবে পাওয়া যাবে, হোম লোন নিতে কি কি লাগবে, বাংলাদেশে হোম লোন ব্যাংক কোনগুলি, হোম লোন ইন্টারেস্টের পরিমাণ কত, হোম লোনের সুবিধা অসুবিধাগুলি এবং হোম লোন কি তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা যায়…সে-সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য। সাথেই থাকুন।
হোম লোন কি?
বাড়ি কেনা বা নির্মাণের জন্য ব্যাংক বা কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়াকে বলা হয় হোম লোন। এই সিস্টেমে ঋণপ্রদানকারীর কাছে সুরক্ষা হিসাবে বন্ধক রাখা হয় ঋণপ্রদানকারীর সম্পত্তি। ব্যাংক কতৃপক্ষ এই সম্পত্তি বা দলিল জমা রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত না গ্রাহক সেই লোন পরিশোধ করতে পারছে।
ব্যাংকিং ভাষায় এভাবে সম্পত্তির বিনিময়ে ঋণ নেওয়াটাকে বলে এলএপি। গ্রাহকের কাছ থেকে বন্দক রাখা এই সম্পত্তি হতে পারে আবাসিক বা বাণিজ্যিক প্রকৃতির মতো যেকোনো ক্যাটাগরির।
আর অন্যদিকে ব্যাংক কতৃপক্ষ এই সম্পত্তিকে গ্যারান্টি হিসাবে ব্যবহার করে। আর ঋণের পরিমাণ সম্পত্তির বাজার মূল্যের উপর নির্ভর করেই গ্রাহককে তা প্রধান করা হয়।
বলে রাখা ভালো হোম লোনের অনেক ক্যাটাগরি আছে। এর মধ্যে হোম পারচেজ লোনের কথা বলা যেতে পারে। এই ধরণের লোন একটি নতুন বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা বা নির্মাণের জন্য সবচেয়ে সাধারণ ধরণের হোম লোন হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
অন্যদিকে এই একই হোম লোনের আন্ডারে আছে হোম ইমপ্রুভমেন্ট লোন। এই লোন মূলত দেওয়া হয় বাড়ির সংস্কারের জন্য। যেসব গ্রাহকর তাদের বাড়ির প্রসার ঘটাতে চান, একটি নতুন ঘর বা একটি নতুন রুম যুক্ত করতে চান তাদের যদি লোনের দরকার হয় সেক্ষেত্রে নিতে পারেন হোম এক্সটেনশন লোন। এটিও হোম লোনেরই একটি ক্যাটাগরি।
এছাড়াও হোম লোনের আন্ডারে রয়েছে সম্পত্তির বিনিময়ে লোন। যাকে কিনা বলা হয় এলপি সিস্টেম। এই সিস্টেম কেবল ইতিমধ্যে বিদ্যমান সম্পত্তির বিনিময়ে নেওয়া ঋণের আবেদন করা ব্যক্তিদের জন্যই!
পাশাপাশি রয়েছে ল্যান্ড পারচেজ লোন। বিনিয়োগ হিসাবে জমি কেনার জন্য আপনি এই লোন নিতে পারবেন। তাছাড়া ভবিষ্যতে বাড়ি তৈরি করার জন্যেও এই লোন নেওয়ার সুযোগ আছে।
সবশেষে বলবো ব্যালেন্স ট্রান্সফার লোনের কথা। আপনি চাইলে হোম লোন পরিশোধের জন্য এই লোন নিতে পারেন। ঋণগ্রহীতাদের কম সুদের হারের সাথে লোন নিতে সাহায্য করে এই লোন সিস্টেম।
হোম লোন কিভাবে পাওয়া যাবে?
যারা এপার্টমেন্ট/ বাড়ি ক্রয় করতে চান, নতুন বাড়ি নির্মাণের প্ল্যান আছে, পুরোনো ফ্লাট বা বাড়ি সংস্কার করতে চান অথবা অন্যান্য ব্যাংক থেকে হোম লোন অধিগ্রহণ করতে চান তারা লোন নিতে পারবেন অর্থ্যাৎ হোম লোন নেবার ক্ষেত্রে উক্ত কারণগুলি থাকলেই হবে।
মনে রাখবেন হোম লোন তাদের জন্যেই যাদের সাধ থাকলেও পর্যাপ্ত সামর্থ্য নেই। যদি আপনার সামর্থ্য থাকে তাহলে আপনাকে হোম লোন গ্রহণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্য বলা ধরা হবে না এবং আপনি হোম লোনও পাবেন না।
এক্ষেত্রে যদি আপনি যোগ্য হোন তবে নিয়মনীতি মেনে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আবেদন করলেই তারা আপনাকে যাচাই-বাছাই করে লোন দিয়ে দিবে। হোম লোন পেতে নিকটস্থ ব্যাংকগুলিতে যোগাযোগ করতে পারেন। তারাই আপনাকে এই ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে।
হোম লোন নিতে কি কি লাগবে?
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবুল ফজল ইতিমধ্যেই হোম লোনের ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। গ্রাহককে উদ্দেশ্য করে তার এই বক্তৃতায় বলা হয়েছে হোম লোন নিতে কি কি লাগবে! চলুন এক নজরে দেখে নিই হোম লোন নিতে কি কি লাগবে:
- ১. যিনি হোম লোনের জন্য আবেদন করবেন তাকে অবশ্যই ২৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী হতে হবে।
- ২. যারা বেসরকারি চাকরি করেন বা কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন তাদের চাকরির স্থায়িত্ব, মাসিক বেতন, ঋণখেলাপির কাগজপত্র শো করতে হবে।
- ৩. সরকারি চাকরি হোক কিংবা বেসরকারি চাকরি! যে চাকরিই করেন না কেনো বেতন হতে হবে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকার মতো।
- ৪. শুধু চাকরিজীবিরাই নন! বরং ব্যবসায়ী ও বাড়িওয়ালারাও এই লোন পাবেন। তবে এক্ষেত্রে ব্যবসা কিংবা বাড়ি সম্পর্কিত ডকুমেন্টস শো করতে হবে।
- ৫. চাকরি এবং ব্যবসা ছাড়া অন্যান্য আয় ইত্যাদির ওপর ব্যাংক হোম লোন পাবেন কিনা সেটা নির্ভর করবে বিভিন্ন ব্যাংকের উপর। সুতরাং এক্ষেত্রে তাদের সাথে কথা বলে নিতে হবে।
- ৬. হোম লোন নিতে আপনার আশেপাশের ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদামতো সব কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের সাথে যোগাযোগ করে বুঝে নিন আর কি কি ডকুমেন্টস লাগবে। কারণ এক এক ব্যাংকে এক এক ধরণের ডকুমেন্টস লাগে।
- ৭. যারা বাড়ি তৈরির জন্য হোম লোন নিবেন তাদের জমির মালিক ও ডেভেলপারের মধ্যে সম্পাদিত যে চুক্তিপত্রটি আছে সেই চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হবে।
- ৮. জমা দিতে হবে নকশার সত্যায়িত ফটোকপি, মূল দলিল, নামজারি খতিয়ান, খাজনা রসিদের সত্যায়িত ফটোকপি।
বাংলাদেশে হোম লোন ব্যাংক কোনগুলি?
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হোম লোন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের এই লোন সুবিধা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেড বা ডিবিএইচের কথা বলা যেতে পারে।
পাশাপাশি বলা যেতে পারে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের কথা। এখানে উল্লেখ্য এই ব্যাংক থেকে হোম লোন নিতে হলে আপনার বয়স ৬৫+ হয়ে ৭০ বছর হলেও কোনো সমস্যা নেই। উক্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেড ব্যাংকও হোম লোন সার্ভিস দিয়ে আসছে।
অন্যদিকে মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড ব্যাংক, সোনালি ব্যাংক, রূপালি ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকেও আবেদন করে হোম লোন গ্রহণ করতে পারবেন।
হোম লোন ইন্টারেস্টের পরিমাণ কত?
এবার আসি হোম লোন ইন্টারেস্টের পরিমাণ কত সে ব্যাপারে। হোম লোন সিস্টেমে সাধারণত বিশেষ একটি ধরণ আছে এবং সেটি হলো ফিক্সড রেট হোম লোন। এই ধরণের লোনে সুদের হার বা ইন্টারেস্ট রেট কখনো ওঠানামা না করে, বরং একই থাকে।
আর এই ধরণের লোন পাবেন আপনি মাত্র ২ বছরের জন্য। বার্ষিক ৭.৪০% থেকে ৮.২০% হারে দেওয়া হবে এই ফিক্সড রেট হোম লোন। তবে স্কিমে বার্ষিক সুদের হার ১২.০০% প্রদান করার সুযোগ আছে। অন্যদিকে ফ্লোটিং ইন্টারেস্ট রেটে সাম্প্রতিক সুদের হার মেইনটেইন করা হয়।
মার্কেটের ওঠা-নামার সাথে এই লোনের সুদের হার উঠানামা করবে। সাধারণ ৬.৭০ থেকে ৭.১৫% হারে এই লোনের সুদ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
হোম লোনের সুবিধা অসুবিধাগুলি কি কি?
চলুন তবে৷ এবারে হোম লোনের সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে জেনে নিই।
সুবিধা:
- সুদের হার এবং লোনের সুরক্ষিত শর্তাবলি
- সুদের উপর ভিত্তি করে কর সুবিধা
- কম সুদের হার সুবিধা
- যোগ্যতাম মানদন্ড যথেষ্ট কম
- বিপদের সময় আর্থিক সুবিধা
অসুবিধা:
- যথেষ্ট রিস্কি
- লোন পরিশোধ করতে না পারলে সম্পত্তি ত্যাগ
- সিদ্ধান্ত গ্রহণের চ্যালেঞ্জিং মুহুর্ত
হোম লোন কি তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা যায়?
হ্যাঁ! অবশ্যই তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা যায়। উপরন্তু হোম লোন যত দ্রুত পরিশোধ করতে পারবেন তত দ্রুত আপনার বন্দক রাখা জমি জমার দলিল ফেরত পাবেন। এছাড়াও হোম লোনের কিছু অংশ প্রি-পেও করা যায়। এতে করে শেষের দিকে লোন পরিশোধ করতে বাড়তি চাপ পড়ে না।