কুরবানী কার উপর ওয়াজিব? যেভাবে কোরবানি করতে হবে
জানুনঃ কুরবানী কার উপর ওয়াজিব? যেভাবে কোরবানি করতে হবে? কোরবানি কি? কুরবানির অর্থ কি? কোরবানির পশু কারা জবাই করতে পারবে? কার উপর কুরবানী ওয়াজিব?
ইসলামে যতো বিধান আছে তার মাঝে অন্যতম হলো কোরবানি। কোরবানি করা হলো ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। এতে আছে আত্মত্যাগের মহিমা ও আর্তের সেবার গৌরব।
আদি পিতে হযরত আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল থেকে শুরু হওয়া এই কোরবানির ইতিহাস মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) এর মহান মহান আত্মবিসর্জনে উজ্জ্বল যা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
কুরবানী কার উপর ওয়াজিব?
কোরবানি কার উপর ওয়াজিব এ নিয়ে একের অধিক মতবাদ রয়েছে। আমরা নিচে মতবাদগুলো নিয়ে দলীলসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
বাংলাদেশে প্রচলিত মতবাদ অনুযায়ী “প্রত্যেক স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থবান মুসলিমদের উপর কোরবানী দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক”।
উপরের মতবাদ অনুযায়ী প্রত্যেকজন সামর্থবান ব্যক্তিকে কোরবানী দিতে হবে। যে পরিবারের স্বামীর সামর্থ আছে সে পরিবারের স্বামীকে কোরবানী দিতে হবে, স্ত্রীর সামর্থ থাকলে স্ত্রীকে দিতে হবে।
যদি ছেলে সামর্থবান হয় তাহলে ছেলেকেও পশু কোরবানি দিতে হবে। আর যদি পরিবারের সবাই সামর্থবান হয়, তাহলে সবাইকেই পশু কোরবানী করতে হবে।
১ম মতবাদঃ কোরবানী করার জন্য ধনী হওয়া জরুরি
কোরবানী করার জন্য ধনী হওয়া জরুরী, এই মতবাদের দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ সে কোরবানী করেনি সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়”[সুনানে ইবনে মাজাহ (৩১২৩), আলবানী ‘সহিহ সুনানে ইবনে মাজাহ’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]
এখানে সামর্থ্য কথাটি দ্বারা ধনী হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। সূত্রঃ এখানে ক্লিক করুন।
কারো জন্য কোরবানী ওয়াজিব হওয়া কিংবা সুন্নত হওয়ার জন্য কোরবানীকারীকে ধনী হওয়া শর্ত। অর্থাৎ তার নিজের খরচপাতি ও সে যাদের খরচ চালায় তাদের খরচপাতির অতিরিক্ত তার কাছে কোরবানী করার অর্থ থাকা।
অতএব, কোন মুসলমানের যদি মাসিক বেতন বা আয় থাকে এবং এ বেতন দিয়ে তার খরচ চলে যায়, এর অতিরিক্ত তার কাছে কোরবানীর পশু কেনার অর্থ থাকে তাহলে সে ব্যক্তি কর্তৃক কোরবানী দেয়ার শরয়ি বিধান রয়েছে।
২য় মতবাদঃ প্রতিটি পরিবারের পক্ষে একটি কোরবানী
প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি কোরবানী দেয়ার বিধান রয়েছে। এই মতবাদের দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একটি কোরবানী দেয়া ওয়াজিব”[মুসনাদে আহমাদ (২০২০৭)]
ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন: হাদিসটির সনদ মজবুত। আলবানী ‘সহিহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (২৭৮৮) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]।
“কোরবানী ওয়াজিব হওয়া কিংবা সুন্নত হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। কোরবানী পুরুষদের উপর যেমন ওয়াজিব হয় তেমনি নারীদের উপরও ওয়াজিব হয়।
কারণ ওয়াজিব হওয়ার দলিলগুলো নর-নারী সবাইকে সমানভাবে শামিল করে।” [সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]। দেখুন: আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা (৫/৭৯-৮১)। সূত্রঃ এখানে ক্লিক করুন।
কোরবানি কি? কুরবানির অর্থ কি?
কোরবানি অর্থ হলো নৈকট্য অর্জন, ত্যাগ স্বীকার করা বা বিসর্জন দেওয়া। কোরবানি হলো জিলহজ মাসের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য শরিয়তের বিধান অনুসারে নিদিষ্ট পশু জবাই করা।
একটি কোরবানি হলো একটি ছাগল, একটি ভেড়া, একটি দুম্বা, এবং একটি গরু, একটি মহিষ ও একটি উটের সাত ভাগের এক ভাগ।
একটি গরু, একটি মহিষ ও একটি উট সাত শরিকে বা সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যায়। গরু, মহিষ ও উটের সাত ভাগের এক ভাগ আকিকা দেওয়া যাবে। আকিকা ও কোরবানি একসাথে করতে কোনো বাধা নেই।
কোরবানির পশু কারা জবাই করতে পারবে?
কোরবানির পশু যেকোনো মুসলিম ভাই জবাই করতে পারবেন। কিন্তু নিজের কোরবানি পশু নিজের হাতে কোরবানি করা উত্তম। দোয়া না জানলেও হবে শুধু বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলে জবাই করতে পারবেন।
কিন্তু আপনি যদি অন্য দোয়া জানেন তাহলে ভালো। নিজে যদি জবাই করতে না পারেন তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে জবাই করাতে পারবেন। কোরবানি পশু জবাই করার সময় নিজে সেই স্থানে উপস্থিত থাকতে পারলে ভালো।
কোরবানির গোশত কারা খেতে পারবে?
কোরবানির গোশত ধনী-গরীব সবাই খেতে পারবেন। তিন ভাগের একভাগ গরীব-মিসকিন তাদের মাঝে বিলিয়ে দিবেন। একভাগ আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে ভাগ করে দিবেন। আর একভাগ নিজের পরিবারের জন্য রেখে দিবেন।
যতো বেশি দিবেন ততো বেশি ভালো। অনেকেই সাত ভাগের এক ভাগ দিয়ে থাকেন আবার অনেকে সামান্য রেখে সবটুকু দিয়ে দেন।
ত্যাগের কোরবানির গোশত ভোগের জন্য পুঞ্জীভূত করে রাখা অনৈতিক ও অমানবিক। কিন্তু বিশেষ কোনো ব্যাক্তির জন্য বা শখের বশে অল্প পরিমানে রাখলে কোনো দোষ নেই।
ওয়াজিব কোরবানি ছাড়া ছোট-বড়, জীবিত-মৃত যেকোনো মানুষের জন্য নফল কোরবানি আদায় করতে পারবেন। তাতে উভয়ে সওয়াবের অধিকারী হবেন।
কার উপর কুরবানী ওয়াজিব?
প্রত্যেকজন সামর্থবান ব্যক্তিকে কোরবানী দিতে হবে। যে পরিবারের স্বামীর সামর্থ আছে সে পরিবারের স্বামীকে কোরবানী দিতে হবে, স্ত্রীর সামর্থ থাকলে স্ত্রীকে দিতে হবে।যদি ছেলে সামর্থবান হয় তাহলে ছেলেকেও পশু কোরবানি দিতে হবে। আর যদি পরিবারের সবাই সামর্থবান হয়, তাহলে সবাইকেই পশু কোরবানী করতে হবে।
নারী যদি সামর্থ্যবান হন তাহলে তার জন্য কোরবানি ওয়াজিব। শিশুদের জন্য কোরবানিসহ কোনো ফরজ ওয়াজিব প্রযোজ্য নয়।
তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়ারা মূলত নারী-পুরুষ তাই তাদের যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে এবং সামর্থ্যবান হবে তখন তাদের জন্য নামাজ, রোজা, যাকাতের মতো কোরবানি ওয়াজিব হবে।
কোরবানি পশু জবাই করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কোরবানির কোনো বিকল্প নেই। টাকা-পয়সা প্রধান, অর্থ-সম্পদ, দান-সদকা করার মাধ্যমে কোরবানি আদায় হবে না।
সামর্থ্যবান কোনো ব্যাক্তি বিশেষ ওজরের কারণে নিজে কোরবানি সম্পাদনে সক্ষম না হলে অন্য কাউকে দিয়ে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে তা সম্পাদন করতে পারবেন।
সেক্ষেত্রে পশুর মূল্য ও ব্যবস্থাপনার যাবতীয় ব্যয় তাকে বহন করতে হবে। কেউ যদি বিনা পারিশ্রমিক করে দেন তাতে ও কোনো ক্ষতি নেই।
কেউ যদি কোরবানির পশু কেনা, জবাই করা সহ গোশত বিতরনের কাজ ও ইত্যাদি কাজের ঝামেলা এড়াতে চান, তাহবে বিশ্বস্ত কোন পরিচিত ব্যাক্তি ও আত্মীয়স্বজনদের কোরবানীর দায়িত্ব দিতে পারেন।
এছাড়াও আপনার গ্রামের লোকজন অথবা কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেচ্চা সেবী সংঘটনকে কোরবানীর যাবতীয় দায়িত্ব দিতে পারেন।
তবে খেয়াল রাখবেন, কুরবানীর সবকিছু যেন নিয়ম অনুসারে হয়। কুরবানীর পাশাপাশি অভাবী মানুষদের ঈদ আনন্দে শামিল করুন।
গরীব, দুঃখী ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের বেশী বেশী আর্থিক দান-অনুদান, জামাকাপড় প্রদান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ঈদের সামগ্রী কিনে দিন। এই কাজগুলো করার মাধ্যমেও আপনি অনেক সওয়াব পাবেন।
শেষ কথাঃ আমাদের আর্টিকেলটি আপনাদের কাছে কেমন লেগেছে অবশ্যই তা কমেন্ট করে জানাবেন। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ্য থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।